ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের সূচনা,শাসন ও পরিনতিঃ
ব্রিটিশ শাসনের সূচনা হয় পলাশীর যুদ্ধের ১৭৫৭ পর থেকে, যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নবাবকে পরাজিত করে এবং ধীরে ধীরে ভারতের অন্যান্য অংশে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে এবং নিম্ম কয়েকটি ধাপে ব্রিটিশ শাসনের পত্তন হয় ।
পলাশীর যুদ্ধ ১৭৫৭ সাল:
এই যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে। এই যুদ্ধের ফলে বাংলার নবাব মীর জাফর ইংরেজদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন:
পলাশীর যুদ্ধের পর প্রায় একশ বছর ১৭৫৭-১৮৫৭সাল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত শাসন করে। এই সময় কোম্পানি ধীরে ধীরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়ায়।
ব্রিটিশ রাজের সূচনা:
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয় এবং সরাসরি ব্রিটিশ রাজের অধীনে ভারত চলে আসে।
উপনিবেশিক শাসন:
পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূচনা হয় এবং ধীরে ধীরে পুরো ভারত ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে আসে। ব্রিটিশ ভারত ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঔপনিবেশিক শাসন, যা ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৫৮ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। একে ভারতীয় সাম্রাজ্য বা ব্রিটিশ রাজ নামে পরিচিত। ব্রিটিশ শাসনের অধীন যে অঞ্চল ছিল, তাকে তখন সাধারণত কেবল ভারত বলা হতো।
ব্রিটিশ রাজের ইতিহাসঃ
ব্রিটিশ রাজের ইতিহাস বলতে ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী ব্রিটিশ শাসনের সময় কালকে বোঝায়। এই শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে, যখন ভারত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনআধীন ছিল। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের শাসন আরম্ভ করে মূলত বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। ১৬০০ সালে, ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে একটি চুক্তি দেয়, যা কোম্পানিরকে ভারতে বাণিজ্য করার অনুমতি দেয়। কোম্পানিটি ভারতে একটি বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলে এবং ধীরে ধীরে রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করে।
১৭৫৭ সালে, পলাশির যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নবাবকে পরাজিত করে। এই যুদ্ধের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসক হয়ে ওঠে। এরপর কোম্পানিটি ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও দখলদারিত্ব বিস্তার করে।
১৮৫৭ সালে, ভারতীয়রা সিপাহি বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানায়। তবে, বিদ্রোহটি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
১৮৫৮ সালে, ব্রিটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে। এরপর ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে একটি ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত করে।
ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের শাসন আরম্ভ করার পেছনে নিম্নলিখিত কারণগুলি উল্লেখযোগ্য:
বাণিজ্য: ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের সম্পদ, যেমন তুলা, চা, এবং মশলা, এর জন্য ভারতে আগ্রহী ছিল।
ধর্ম: ব্রিটিশরা মনে করত যে, ভারতীয়দের উন্নত করতে হলে তাদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করতে হবে।
সামরিক: ব্রিটিশরা ভয় করত যে, ভারতীয়রা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে।
ব্রিটিশদের ভারতবর্ষের শাসন ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই শাসন ভারতীয় সংস্কৃতি, অর্থনীতি, এবং রাজনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
ব্রিটিশ ভারতঃ
ব্রিটিশ ভারত ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঔপনিবেশিক শাসন, যা ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৫৮ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। একে ভারতীয় সাম্রাজ্য বা ব্রিটিশ রাজ নামেও ডাকা হয়। ব্রিটিশ শাসনের অধীন যে অঞ্চল ছিল, তাকে তখন সাধারণত কেবল ভারত বলা হতো। এই অঞ্চলে দুই ধরনের এলাকা অন্তর্ভুক্ত ছিল— প্রথমত, যেসব এলাকা সরাসরি যুক্তরাজ্যের দ্বারা পরিচালিত হতো, সেগুলোকে একত্রে বলা হতো ব্রিটিশ ভারত দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশ আধিপত্যের অধীনে দেশীয় শাসকদের দ্বারা শাসিত ছিল কিছু অঞ্চল ছিল, যেগুলোকে বলা হতো দেশীয় রাজ্য বা প্রিন্সলি স্টেটস। এই অঞ্চলকে কখনও কখনও ভারতীয় সাম্রাজ্য নামেও অভিহিত করা হতো। ভারত হিসেবেই এই অঞ্চল সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে যোগদান করেছিল এবং ১৯৪৫ সালে সান ফ্রান্সিস্কোতে গঠিত জাতিসংঘেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য লাভ করে। ভারত ১৯০০, ১৯২০, ১৯২৮, ১৯৩২ ও ১৯৩৬ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করেছিল।
ব্রিটিশ ভারতের পত্তন ও ভারতীয় উপনিবেশঃ
ব্রিটিশ ভারত ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঔপনিবেশিক শাসন, যা ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৫৮ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। একে ভারতীয় সাম্রাজ্য বা ব্রিটিশ রাজ নামেও ডাকা হয়। ব্রিটিশ শাসনের অধীন যে অঞ্চল ছিল, তাকে তখন সাধারণত কেবল ভারত বলা হতো।
ব্রিটিশ ভারতের ভৌগোলিক সীমারেখাঃ
অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির অধীনস্ত গোয়া এবং পুদুচেরির (পন্ডিচেরি) মতো কয়েকটি ছোট এলাকা ছাড়া বর্তমানের প্রায় পুরো ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার জুড়ে ব্রিটিশ ভারত বিস্তৃত ছিল।এই অঞ্চলটি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়, যাতে রয়েছে হিমালয় পর্বতমালা, উর্বর প্লাবনভূমি, সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমি, দীর্ঘ উপকূলরেখা, উষ্ণমণ্ডলীয় শুষ্ক বনাঞ্চল, শুষ্ক উঁচু ভূমি, এবং মরুভূমি। এর পাশাপাশি, বিভিন্ন সময়ে এর অন্তর্ভুক্ত ছিল অ্যাডেন (১৮৫৮ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত) নিম্ন বার্মা (১৮৫৮ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত), উচ্চ বার্মা (১৮৮৬ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত), ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ড (১৮৮৪ থেকে ১৮৯৮ পর্যন্ত), এবং প্রণালী উপনিবেশ (১৮৫৮ থেকে ১৮৬৭ পর্যন্ত)। ১৯৩৭ সালে বার্মাকে ভারত থেকে আলাদা করা হয় এবং ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জনের আগ পর্যন্ত এটি ব্রিটিশ ক্রাউনের দ্বারা সরাসরি শাসিত হয়। পারস্য উপসাগরের ক্রশিয়াল প্রণালী এবং পারস্য উপসাগর রেসিডেন্সির অধীন অন্যান্য রাজ্যগুলো তত্ত্বগতভাবে ব্রিটিশ ভারতের প্রেসিডেন্সি ও প্রদেশের মতো দেশীয় রাজ্য ছিল এবং তারা মুদ্রা হিসেবে রুপি ব্যবহার করত।
এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মধ্যে সিলন (বর্তমানে শ্রীলঙ্কা), যার মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপটির উত্তরাংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল, ১৮০২ সালে অ্যামিয়েন্স চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেনের অধীনে নিয়ে আসা হয়। এই উপকূলীয় অঞ্চলগুলো ১৭৯৩ থেকে ১৭৯৮ সাল পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অধীনে পরিচালিত ছিল।তবে পরবর্তী সময়ে সেখানের ব্রিটিশ গভর্নররা সরাসরি লন্ডনের কাছে জবাবদিহি করতেন, এবং এটি ব্রিটিশ ভারতের অংশ ছিল না। নেপাল এবং ভূটান রাজ্যগুলো ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ করার পর তাদের সঙ্গে চুক্তি করে এবং ব্রিটিশ কর্তৃক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সিকিম রাজ্য ১৮৬১ সালের অ্যাংলো-সিকিম চুক্তির পর একটি দেশীয় রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও সার্বভৌমত্বের বিষয়টি অস্পষ্ট ছিল।মালদ্বীপ ১৮৮৭ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত একটি ব্রিটিশ আশ্রিত রাজ্য ছিল, কিন্তু এটি ব্রিটিশ ভারতের অংশ ছিল না।
ব্রিটিশরা কিভাবে ভারতবর্ষের শাসন আরম্ভ করেছিল
রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে 1757 সালে পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয় এবং 1947 সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে শেষ হয়। এই সময়কালে, ব্রিটিশ ভারতকে প্রশাসনিক উদ্দেশ্যে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল - ব্রিটিশ প্রাচ্যের অঞ্চলগুলি। ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ব্রিটিশ ক্রাউন। ব্রিটিশ শাসনের এই সময়কে ব্রিটিশ রাজ হিসাবেও উল্লেখ করা হয়।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের এই সময়কালে, অনেক পরিবর্তন ঘটে যা দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে প্রভাবিত করে। ব্রিটিশরা তাদের নিজস্ব আইন ও প্রবিধান নিয়ে আসে এবং রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ এবং খালের মতো অবকাঠামো স্থাপন করে যা দেশটিকে সংযুক্ত করে এবং এটিকে আরও উন্নত করে। ভারতে ব্রিটিশ সরকারও কৃষি উৎপাদন ও শিল্প বৃদ্ধির জন্য বেশ কিছু নীতি ও সংস্কার বাস্তবায়ন করেছে।
ব্রিটিশরা ভারতে যে সবচাইতে প্রভাবশালী নীতি প্রয়োগ করেছিল তা হল ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থাটি ছিল এই ধারণার উপর ভিত্তি করে যে ব্রিটিশরা দেশের সমস্ত জমির ন্যায্য মালিক ছিল এবং এই ভিত্তিটি ভারতীয় জনসংখ্যা থেকে কর আদায়ের জন্য ব্যবহার করেছিল। এই ব্যবস্থাটি অত্যন্ত বিতর্কিত ছিল এবং অনেক ভারতীয় এর দ্বারা বিরক্ত ছিল।
এছাড়াও, ব্রিটিশরা ভারতজুড়ে একটি অভিন্ন আইন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল। এর মধ্যে ভারতীয় দণ্ডবিধি অন্তর্ভুক্ত ছিল যা 19 শতকে আরোপ করা হয়েছিল এবং ভারতে একটি অভিন্ন আইন ব্যবস্থা তৈরি করতে চেয়েছিল। তারা সংস্কৃতের মতো আঞ্চলিক ভাষার পরিবর্তে ইংরেজিকে দেশের সরকারী ভাষা হিসেবে প্রবর্তন করতে চেয়েছিল।
ব্রিটিশরাও এক-ধর্ম নীতি আরোপ করার চেষ্টা করেছিল, যদিও তারা এতে সফল হয়নি। তারা ভারতে খ্রিস্টধর্মের অনুশীলনকে উৎসাহিত করেছিল এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে খ্রিস্টান স্কুল ও গীর্জা নির্মাণ করেছিল।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই ছিল। এটি অবকাঠামো এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন এনেছে, কিন্তু ভারতীয় জনগণের কাছ থেকে প্রচুর বিরক্তিও এনেছে। ভারতে ব্রিটিশ শাসন 1947 সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে শেষ হয়, এইভাবে দেশে ব্রিটিশ প্রভাবের দীর্ঘ সময়ের অবসান হয়।